রবিবার, ফেব্রুয়ারি 2, 2025

‘লক্ষ্মী’ থেকে লক্ষ্মীপুর, যার আরেক নাম সয়াল্যান্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক :
লক্ষ্মী শব্দটি থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে। লক্ষ্মী বলতে ধন-সম্পদ ও সৌভাগ্যের দেবী বুঝায় এবং পুর হলো শহর বা নগর। এ হিসাবে লক্ষ্মীপুর এর সাধারণ অর্থ দাঁড়ায় সম্পদ সমৃদ্ধ শহর বা সৌভাগ্যের নগরী। হয়তো সেই কারণেই দেশের মোট উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ সয়াবিন উৎপাদিত হয় এ জেলায়। সেই সুবাদে ২০১৬ সালে জেলার ব্র্যান্ড বা পরিচিতি হিসেবে সয়াবিনকে চিহ্নিত করে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন। নতুন ভাবে লক্ষ্মীপুর জেলাকে পরিচিত করা হয় ‘সয়াল্যান্ড বা সয়াবিনের লক্ষ্মীপুর’ নামে।

সয়াবিন ক্ষেত

এ জেলার কৃতি সন্তান বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ মো. নাজিম উদ্দিন মাহমুদের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লক্ষ্মীপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ থেকে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলার নামকরণে মতভেদ রয়েছে। ঐতিহাসিক কৈলাশ চন্দ্র সিংহ রচিত ‘রাজমালা বা ত্রিপুরা’র ইতিহাসে ‘লক্ষ্মীপুর’ নামে একটি মৌজা ছিল। অন্যমতে, ঐতিহাসিক ‘লক্ষ্মীদাহ পরগনা’ থেকে লক্ষ্মীপুর নামকরণ করা হয়েছে। এ জেলার কৃতি সন্তান বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সানা উল্যাহ নুরী’র ‘সুজা বাদশা সড়ক’ নামে রচিত ইতিহাস গ্রন্থে ‘লক্ষ্মীদাহ পরগনা’র কথা উল্লেখ রয়েছে। ঐতিহাসিক ড. বোরাহ ইসলামাবাদকে লক্ষ্মীপুর বলে ধারণা করেছিলেন। আবার শ্রী সুরেশ চন্দ্রনাথ মজুমদার ‘রাজপুরুষ যোগীবংশ’ নামক গবেষণামূলক গ্রন্থে লিখেছেন, দালাল বাজারের জমিদার রাজা গৌর কিশোর রায় চৌধুরীর বংশের প্রথম পুরুষের নাম লক্ষ্মী নারায়ণ রায় এবং রাজা গৌর কিশোরের স্ত্রীর নাম লক্ষ্মী প্রিয়া। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ মনে করেন, লক্ষ্মী নারায়ণ রায় বা লক্ষ্মী প্রিয়া’র নামানুসারে লক্ষ্মীপুরের নামকরণ করা হয়েছিল।

লক্ষ্মীপুর জিরো পয়েন্ট (মাইল ফলক)

এ জেলার ইতিহাস গাঁথা গ্রন্থসমূহ থেকে জানা যায়, ত্রয়োদশ শতাব্দিতে লক্ষ্মীপুর ভুলনা রাজ্যের অধীন ছিল। মুঘল ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে লক্ষ্মীপুরে একটি সামরিক স্থাপনা ছিল। ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দি পর্যন্ত এ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে লবন উৎপন্ন হত এবং বাইরে রপ্তানি হত। তৎকালীন সময়ে লবনের কারণে এখানে লবন বিপ্লব ঘটেছিল। স্বদেশী আন্দোলনে লক্ষ্মীপুরবাসী স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করায় মহাত্মা গান্ধি এ অঞ্চল ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি তখন প্রায়ই বর্তমান রায়পুর উপজেলার কাফিলাতলী আখড়া ও রামগঞ্জের শ্রীরামপুর রাজবাড়িতে অবস্থান করতেন। ১৯২৬ সালের জুন মাসে লক্ষ্মীপুর সফরে এসেছিলেন জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ্মীপুরে পাক-হানাদার বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে সতের বার যুদ্ধ হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ অঞ্চলে তিনটি স্মৃতিস্তম্ভ, দুইটি গণকবর ও একটি গণহত্যা কেন্দ্রের খোঁজ পাওয়া যায়।

১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ জেলায় রয়েছে, ৪টি সংসদীয় আসন, ৫টি উপজেলা, ৪টি পৌরসভা, ৫৮টি ইউনিয়ন পরিষদ এবং প্রায় ৫৩৬টি গ্রাম। ৪টি সংসদীয় আসন হলো, লক্ষ্মীপুর-০১ (রামগঞ্জ), লক্ষ্মীপুর-০২ (রায়পুর-সদর আংশিক), লক্ষ্মীপুর-০৩ (সদর) এবং লক্ষ্মীপুর-০৪ (রামগতি-কমলনগর)। এছাড়াও চন্দ্রগঞ্জ নামে একটি নতুন পৌরসভা প্রতিষ্ঠার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মেঘনা ছাড়াও এখানে রয়েছে, ডাকাতিয়া, কাটা খালি, রহমত খালি ও ভুলুয়াসহ বেশ কয়েকটি নদী ও খাল। প্রায় ১৮ লাখ মানুষের আবাসভূমি এ জেলার আয়তন ১৪৫৫.৯৬ বর্গ কিলোমিটার।

রায়পুর মসজিদ-ই আব্দুল্যাহ

দেশে বিদেশে সুনাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে আছে এমন বহু গুণী ব্যক্তির জন্ম এই লক্ষ্মীপুরে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত লেখক ও শিক্ষাবিদ নাজিম উদ্দিন মাহমুদ। ‘লক্ষ্মীপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ নামে তাঁর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছেন ভাষা সৈনিক কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহা, বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ও স্বাধীন দেশের প্রথম পতাকা উত্তোলক আ স ম আব্দুর রব এর জন্ম এই লক্ষ্মীপুরে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক উপাধি প্রদান করেছিলেন। বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সানা উল্লাহ নুরী। ১৯৮২ সালে সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় কৃতিত্বের জন্য একুশের রাষ্ট্রীয় স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর প্রাক্তণ চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান ও দেশের সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান হামদর্দ এর চেয়ারম্যান ড. ইউসূফ হারুন ভূঁইয়া এ জেলারই কৃতি সন্তান। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রথম নারী এভারেস্ট জয়ী নিশাত মজুমদারের মতো অসংখ্য গুণী ব্যক্তির জন্মস্থান এই লক্ষ্মীপুর।

দালাল বাজার জমিদার বাড়ি

এ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে, দালাল বাজার জমিদার বাড়ি, শাহ জকি (রাঃ) মাজার শরীফ, তিতাখাঁ জামে মসজিদ, মজুপুর মটকা মসজিদ, রায়পুর জ্বীনের মসজিদ, রায়পুর মৎস প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (এশিয়ায় বৃহত্তম), রায়পুর বড় মসজিদ, মান্দারী বাজার বড় জামে মসজিদ, নন্দী গ্রামের নাগ বাড়ি, দালাল বাজার মঠ ও খোয়া সাগর দিঘী, রামগতি বুড়াকর্তা মন্দির ও মেলার মতো মহু নিদর্শন। এছাড়াও ভ্রমণ পিয়াসুদের জন্য রয়েছে, আলেকজান্ডার মেঘনা বীচ, মতিরহাট বালুচর, মজুচৌধুরীহাট, পৌর শিশু পার্ক, রামগঞ্জের শ্রীরামপুর রাজবাড়ী, দিঘলী নবীনগর, কমলা সুন্দরী দিঘীর মতো অসংখ্য দৃষ্টি নন্দন স্থান।

লক্ষ্মীপুরের পথে পথে সুপারি বেচাকেনা

‘নারিকেল, সুপারি আর সয়াবিনে ভরপুর, আমাদের আবাসভূমি প্রিয় লক্ষ্মীপুর’। হ্যাঁ, এ জেলায় প্রচুর পরিমাণে নারিকেল, সুপারি ও সয়াবিন উৎপাদিত হয়। এছাড়াও ধান, গম, সরিষা, বাদাম, পাট, মরিচ, আলু, ডাল, ভুট্টা, আখ ও চীনাবাদাম প্রচুর পরিমাণে এখানে চাষাবাদ হয়ে থাকে। এ এলাকায় খুব পরিচিত ফলের মধ্যে রয়েছে, আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, আমড়া, জাম ও তাল ইত্যাদি। এ জেলার অধিকাংশ মানুষ কৃষি ও মৎস শিকারের কাজে নিয়োজিত রয়েছে।

কমলনগর উপজেলার মতিরহাট মেঘনা বীচ

বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটনমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল এমপি লক্ষ্মীপুরের কৃতি সন্তান। তিনি লক্ষ্মীপুর-০৩ আসনের বর্তমান সাংসদ ও আওয়ামী লীগের একজন প্রবীণ নেতা। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর পার্লামেন্টে তিনি এ আসনের সাংসদ ছিলেন। লক্ষ্মীপুর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, মেঘনা নদীর উপকূলে অবস্থিত একটি জেলা লক্ষ্মীপুর। এক সময় বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের অন্তভূক্ত ছিল এটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদে ভরপুর এ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য অল্প কথায় বলে শেষ করা যাবে না। এছাড়াও কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি শিঘ্রই দেশের শিল্প ও পর্যটনের জন্যেও লক্ষ্মীপুর বিখ্যাত হয়ে উঠবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর

BN