পল্লী নিউজ ডেক্স: গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর জোটসঙ্গী স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াত ছাড়াই বৃহত্তর ঐক্য গড়তে চায় বিএনপি। বুধবার রাতে জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে এমনই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। ২০ দলীয় জোট নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এ তথ্য।
ক্ষমতাসীন জোটের বাইরেও অনেক রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি রয়েছেন। তাদের নিয়ে বিএনপি অনেক আগে থেকেই ঐক্য গড়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় জামায়াত। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে বিএনপির হাইকমান্ডও এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের ডাকে ক্ষমতাসীনরা সাড়া না দিলেও উগ্র ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্য গড়তে যারাই অন্তরায় হবে খালেদা জিয়া তাদের এড়িয়ে চলবেন। প্রয়োজনে তাদের ত্যাগ করতেও তিনি দ্বিধাবোধ করবেন না বলে বিএনপি ও জোট সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বুধবার রাতে জোটের বৈঠকে কয়েক নেতা জাতীয় ঐক্য গড়ার ওপর জোর দেন। তবে এক্ষেত্রে জামায়াত মূল বাধা বলে কেউ কেউ ইঙ্গিত দেন। জোটের এক নেতা বলেন, সরকারসহ অনেকেই বলছেন, জামায়াত ত্যাগ করলেই ঐক্য সম্ভব। তাই বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। এ সময় বৈঠকে উপস্থিত জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য আবদুল হালিম জোট নেতাদের বক্তব্য খণ্ডন করেন। জোটের বাইরে যারা বিএনপিকে জামায়াত সঙ্গ ত্যাগের ব্যাপারে বলছেন, তাদের জনপ্রিয়তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। এরপর জামায়াতের ওই নেতাকে উদ্দেশ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বি. চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীসহ অন্য যারা জামায়াত সঙ্গ ত্যাগের কথা বলছেন, ভোটের রাজনীতিতে তাদের অবদান না থাকলেও সমাজে তাদের গুরুত্ব রয়েছে।’ খালেদা জিয়ার এই মন্তব্যের পর জোটের ওই বৈঠকেই জামায়াত সঙ্গ ত্যাগ নিয়ে সবার মাঝে গুঞ্জন তৈরি হয়। জোটের এক শীর্ষ নেতা যুগান্তরকে বলেন, এর আগে কখনও খালেদা জিয়া জামায়াত সঙ্গ ত্যাগের ব্যাপারে এমন বক্তব্য দেননি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ বৃহস্পতিবার বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। সবার সঙ্গে মতবিনিময়ের পাশাপাশি তাকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, আবারও আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল বা সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকদের জাতীয় ঐক্যের কথা বলার জন্য। খালেদা জিয়া তাতে সম্মতি জানিয়েছেন। তিনি ঐক্য গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
তিনি বলেন, আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে জামায়াত। সেই ভুলের আজ পর্যন্ত ক্ষমা চায়নি দলটি। এই মুহূর্তে কার ভোট বেশি বা কম তা কোনো প্রশ্ন নয়। এখন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বসেছে। এই অবস্থায় ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে পাল্লা যেদিকে ভারি হবে, সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবাই যদি জামায়াত সঙ্গ ত্যাগ করতে বলে জাতীয় ঐক্য গড়ার ক্ষেত্রে বিএনপিকে সেটা করতে হবে।
এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আরও বলেন, আওয়ামী লীগ যদি খালেদা জিয়ার ডাকে সাড়া না দেয়, তাও তো দেশ ও আন্তর্জাতিক মহল দেখবে। তারা যা বোঝার বুঝে নেবে। তবে এবার খালেদা জিয়া বসে থাকবেন না।
এদিকে উগ্র ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ১৯ জেলায় সমাবেশ করার যে পরামর্শ খালেদা জিয়াকে দলের কয়েক নেতা দিয়েছিলেন তা নিয়ে বিএনপিতে শংকা দেখা দিয়েছে। দলের একটি অংশ মনে করে, গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর কারও কোনো জীবনের নিরাপত্তা নেই। এই অবস্থায় রাজপথে কোনো কর্মসূচি দিলে সরকারই তা ভণ্ডুল করতে তৎপরতা চালাতে পারে। কারণ, সরকার কোনোভাবেই চায় না বিএনপি রাজপথে সক্রিয় হোক। তাই, এই নিয়ে আরও ভাবতে হবে। জোটের বৈঠকেও খালেদা জিয়ার বক্তব্যে তা ফুটে ওঠে। জোটের পক্ষ থেকে উগ্র ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন, কালো পতাকা র্যালি, বিভাগীয় শহরে সমাবেশ শেষে ঢাকায় সবাইকে নিয়ে জাতীয় কনভেনশন করার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া নানা শংকার কথা জানিয়ে জোটের শরিক দলগুলোকে সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী করার নির্দেশনা দেন।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য প্রায় এক সুরে বলেন, সার্বিক পরিস্থিতিতে উগ্র ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দলকে রাজপথে নামতে হবে। সরকার তো চাইবেই যাতে বিএনপি কোনো কর্মকাণ্ড না করতে পারে। এ সুযোগটা দেয়া ঠিক হবে না। নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে হলে সভা-সমাবেশ করতে হবে। যদি কোনোভাবে সরকার কর্মসূচি করতে না দেয়, কমপক্ষে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে তারা এসব কর্মসূচি নিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলবেন।
বুধবার রাতে জোটের বৈঠকের পর দলের স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। ওই বৈঠকে তিনি বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য হতে হবে। সরকার যদি সাড়া না দেয়, তাহলে আমরা সবার সঙ্গে কথা বলব। সবার মতামত নিয়ে আবার স্থায়ী কমিটির বৈঠক আহ্বান করা হবে। সেখানে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমরা চলমান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গোটা দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে চাই। তাই ভেবেচিন্তে সবার মতামত নিয়ে সামনের দিনগুলো চলতে চাই।
এদিকে গুলশান-শোলাকিয়া হামলার পর দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের ভূমিকায় খালেদা জিয়া বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। বৈঠকে এক নেতা বলেন, গুলশানের ঘটনার ১০ দিন পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হল, এ ঘটনার সঙ্গে খালেদা জিয়ার হাত রয়েছে। এভাবে যদি বারবার তারা একটা মিথ্যা কথা বলতে থাকে তাহলে দেশী-বিদেশী সবাই তা বিশ্বাস করতে শুরু করবে। জবাবে খালেদা জিয়া জানতে চেয়েছেন, ‘আপনারা কেন এ বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দিচ্ছেন না। যতদূর দেখেছি, হান্নান শাহ ও গয়েশ্বর শুধু বক্তব্য রাখছেন। এখন থেকে সবাই একই সুরে কথা বলবেন।’ খালেদা জিয়ার এমন মন্তব্যের পর সেখানে উপস্থিত দুই নেতা বলেন, ‘ম্যাডাম আমরাও এই ইস্যুতে জোরালো বক্তব্য রাখছি।’