একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার কমান্ডার ও জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
শনিবার রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে ঢাকার অদূরে গাজীপুরের কাশিমপুর-২ কারাগারে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়ায় কারাগারে ফাঁসির মঞ্চের পাশে উপস্থিত ছিলেন আইজি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন, অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন) কর্নেল ইকবাল হাসান, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম আলম, পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ, সিভিল সার্জন ডা. হায়দার আলী খান, কাশিমপুর কারাগার-২ এর সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক, জেলার নাশির আহমেদ প্রমুখ। নিয়ম অনুযায়ী দণ্ড কার্যকরের পর তারা সাক্ষী হিসেবে নির্দিষ্ট বইয়ে স্বাক্ষর করেন।
ফাঁসি কার্যকরে দায়িত্বে ছিলেন চার জল্লাদ। তারা হলেন-শাহজাহান, রিপন, দীন ইসলাম ও শাহীন। ফাঁসির আগে জল্লাদ শাহজাহানের নেতৃত্বে মঞ্চ ঘিরে শনিবার সন্ধ্যার পর দুই দফা মহড়া হয়।
পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে মীর কাসেমকে জম টুপি পরিয়ে মঞ্চে তোলেন জল্লাদরা। এর আগে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন চিকিৎসক ডা. মিজান ও ডা. কাউছার।
ফাঁসি কার্যকরের খবর জানার পর কাশিমপুর কারাফটকে আনন্দ প্রকাশ করেন অপেক্ষমান মুক্তিযোদ্ধারা।
এ নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ছয় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো। তবে কাশিমপুর কারাগারে কোনো যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা এটিই প্রথম।
কে এই মীর কাসেম: জামায়াতের কর্মপরিষদের সদস্য ও দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন মীর কাসেম আলী। তিনি ছিলেন একাত্তরে ‘চট্টগ্রামের ত্রাস’। ধূর্ততার সঙ্গে নিজের বিত্ত-বৈভব বাড়িয়েছেন তিনি। ১৯৮০ সালে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হন মীর কাসেম। তিনি ছিলেন ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। একাত্তরে ছাত্র সংঘের সভাপতি ও আল-বদর বাহিনীর জেলা কমান্ডার ছিলেন মীর কাসেম। পরে তিনি ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ গঠন করে এর প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান হন। মীর কাসেম ইবনে সিনা ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
যে অপরাধে মৃত্যুদণ্ড: মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম ডালিম হোটেলে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমউদ্দিনকে অপহরণ করে নির্মমভাবে নির্যাতনের পর হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড হয় আল বদর বাহিনীর কমান্ডার মীর কাসেমের। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া এই মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে গত ৩০ আগস্ট মীর কাসেমের রিভিউ আবেদন খারিজ করেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগ। এরপর ওইদিন বিকেলে আদেশের কপিতে স্বাক্ষর করেন বেঞ্চের বিচারপতিরা। পরে তা সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয় ও অনুলিপি কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ৩১ আগস্ট সকালে কাশিমপুর কারাগারে মীর কাসেমকে রায় পড়ে শোনান হয়।
এরপর তার কাছে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া না চাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। প্রথমে তিনি সিদ্ধান্ত জানাতে ‘নিখোঁজ’ সন্তানকে ফিরে পাওয়ার শর্ত দেন। তবে ২ সেপ্টেম্বর মীর কাসেম সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কারা কর্তৃপক্ষকে জানান, তিনি প্রাণভিক্ষা চাইবেন না। এরপরই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে কারা কর্তৃপক্ষ।
একাত্তরে মানবাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিল থেকে মীর কাসেমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সেই থেকে তিনি কারাগারে। ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুটি অভিযোগে তাকে ফাঁসির আদেশ ও আটটি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রসিকিউশনের আনা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে দশটিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড এবং বাকী ৮টি অভিযোগে সব মিলিয়ে ৭২ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর আপিল করেন মীর কাসেম।
গত ৮ মার্চ চট্টগ্রামের আল বদর বাহিনীর কমান্ডার মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিলের সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। ওই রায়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমউদ্দিনসহ ছয়জনকে অপহরণের পর চট্টগ্রাম শহরের আন্দারকিল্লায় ডালিম হোটেলে নির্মমভাবে নির্যাতনের করে হত্যার দায়ে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। এরপর ওইদিন রাতে বিচাররিক আদালতের স্বাক্ষরের পর মৃত্যু পরোয়ানা লাল সালুতে মুড়িয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় তিন মাস পর ২৪৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি গত ৬ জুন প্রকাশ হয়। পরদিন তা মীর কাসেমকে পড়ে শোনানো হয়। এরপর আপিল বিভাগের রায় বাতিল চেয়ে রিভিউ আবেদন করেন মীর কাসেম। শুনানি শেষে গত ৩০ আগস্ট তা খারিজ করেন আপিল বিভাগ।