নির্বাচন কমিশন (ইসি) বা সরকারের পক্ষ থেকে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে চাপ দেওয়া হচ্ছে কিনা তা জানতে চেয়েছেন কূটনীতিকরা। একই সঙ্গে নির্বাচনে সহিংসতা ও ভোটের ফল ঘোষণার সময় সম্পর্কে জানতে চান তারা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ইসির ব্রিফিংয়ে এসব বিষয়ে প্রশ্ন করেন কূটনীতিকরা।
আগামী ৭ জানুয়ারির ভোট নিয়ে বৃহস্পতিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের রুদ্ধদ্বার ব্রিফিং করে ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে অন্য নির্বাচন কমিশনার এবং ইসি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এতে উপস্থিত ছিলেন। ঢাকায় কর্মরত সব দেশের কূটনীতিক ও প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।
ব্রিফিং শেষে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোসটার সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন একটি ভালো নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ভালো কিছু করতে তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। তবে তারা বলেছেন, যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার জন্য ইসি দায়ী নয়।’
ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘চীন আশা করে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে এবং যা হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি মাইলফলক।’ নির্বাচন সফলভাবে শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ আরও শক্তিশালী, স্থিতিশীল এবং ঐক্যবদ্ধ হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নির্বাচন উপলক্ষে এদিন সোনারগাঁও হোটেলে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমের জন্য মিডিয়া সেন্টার উদ্বোধন করেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। পরে তিনি বলেন, ‘কূটনীতিকরা বিভিন্ন সময় আমাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। তাদের সবার প্রত্যাশা, নির্বাচনটা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে হোক। আমরাও সেটাই চাই। ভোটের শেষ মুহূর্তের পরিস্থিতি তাদের জানানো হয়েছে।’
সিইসি বলেন, ‘কূটনীতিকরা দু-চারটি প্রশ্ন করেছেন। এর মধ্যে একটি হলো– নির্বাচনকে ঘিরে কত সংখ্যক অভিযোগ পাচ্ছি। তাদের জানিয়েছি, ইসি প্রায় ছয়শ অভিযোগ পেয়েছে, যার মধ্যে চারশর মতো আমলে নিয়েছে। সেগুলোর বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে।’ এ ছাড়া ভোটের ফল ঘোষণার বিষয়ে কূটনীতিকরা জানতে চান বলে উল্লেখ করেন সিইসি।
তিনি বলেন, ‘আমরা জানিয়েছি, ফলের ব্যাপারে আমরা একটি অ্যাপ তৈরি করেছি– ‘স্মাট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ’। ভোট চলাকালে দুই ঘণ্টা পরপর এই অ্যাপে ভোট পড়ার হার হালনাগাদ করা হবে। যে কেউ পৃথিবীর যে কোনো জায়গা থেকে জানতে পারবেন কত ভোট পড়ছে। যেমন ধরুন ২০ শতাংশ ভোট পড়ল এবং দুই ঘণ্টা পর তা ৩০ শতাংশ হয়েছে। দুই ঘণ্টা পরে আরও ৩০ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু যদি লাফ দিয়ে ৮০ শতাংশ হয়ে যায়, তাহলে সন্দেহ তৈরি করবে।’ স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে অ্যাপটি চালু করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল।
সিইসি আরও বলেন, ‘কূটনীতিকরা জানতে চেয়েছেন, সরকার বা ইসি থেকে ভোটকেন্দ্রে যেতে ভোটারদের চাপ দেওয়া হচ্ছে কিনা। তাদের বলেছি, ইসি থেকে চাপ সৃষ্টির কোনো কারণ নেই। তবে আমরা ভোট দিতে ভোটারদের প্রতি আবেদন রাখি, এটা আমাদের দায়িত্বের অংশ, চাপ নয়, এটা সচেতনতা তৈরি।’
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে কূটনীতিকরা কিছু জানতে চেয়েছেন কিনা– সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সিইসি বলেন, ‘এ বিষয়ে তারা কিছু জিজ্ঞেস করেনি।’ আগামী ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন সহিংসতার আশঙ্কা সম্পর্কেও কোনো মন্তব্য করেননি সিইসি।
তবে এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘এটা পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি। তবে সহিংসতার বিষয়টি আমরা আস্তে আস্তে ক্লিয়ার হয়ে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু জায়গায় ইসি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছে– তারপর আর সহিংসতার খবর পাচ্ছি না। তারাও (কূটনীতিকরা) খবরের কাগজে এগুলো পড়ছেন।’
পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, ‘সিইসি বলেছেন, যদি ৪টায় ভোট শেষ হয়; কিন্তু কেন্দ্রে লোক থাকে– তাহলে আরেকটু সময় অ্যালাউ করা হবে। এমনও হতে পারে, কোনো সেন্টারে ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ হবে। তবে রাত ১০টা থেকে আমরা রেজাল্ট পেতে থাকব। পরদিন সকাল ৯টা-১০টার মধ্যে রেজাল্ট হয়ে যাবে।’
একটি সূত্র জানায়, রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সিইসি কূটনীতিকদের বলেন, ‘আপনারা জানেন, সুনির্দিষ্ট বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অরাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়ে ভোট বর্জন করেছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের সময় ভিন্ন সরকার রাখতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। আর তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্মিলিত ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তের ওপর। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার ইসিকে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা করছে।’
কাজী হাবিবুল আউয়ালে কূটনীতিকদের আরও বলেন, ‘এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রধান বিরোধী দল এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে এলে এটি আরও অংশগ্রহণমূলক হতো। তারা বারবার বলেছে, নির্বাচনের আগে ইসি ও সরকারকে সরে যেতে হবে, তবে তারা তা আদায় করতে পারেনি। ফলে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই।’
সিইসি জানান, প্রায় আট লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ভোট গ্রহণে যুক্ত থাকবেন। আরও এক লাখ অতিরিক্ত থাকবেন। সব মিলিয়ে ৯ লাখের প্রস্তুতি আছে। আর আনসার, ভিডিপি, র্যা ব, বিজিবি মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৮ লাখ সদস্য মাঠে আছেন। প্রায় তিন হাজার ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারক মাঠে দায়িত্ব পালন করবেন।