গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ দীর্ঘদিন জলবায়ু পরিবর্তন ও আবহাওয়া নিয়ে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষণারত। এর আগে তিনি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলু এবং বাংলাদেশের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন।
সমকাল: এ বছরের বন্যার ধরন, গতিবিধি ও ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?
মোস্তফা কামাল পলাশ: ২০২২ সালে বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বড় মাপের বন্যা হওয়ার আশঙ্কা আছে। এতে বেশি জেলা বন্যার পানিতে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে লা-নিনা অবস্থা বিরাজ করছে। লা-নিনার বছরগুলোতে ভারতীয় উপমহাদেশে বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বড় বন্যা হয়। আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌসুমি বৃষ্টিপাত পূর্বাভাস ২০২২ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে বাংলাদেশের রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নির্দেশ করেছে। এ পূর্বাভাস সঠিক হলে সুরমা ও মেঘনা অববাহিকায় চলমান বন্যা ছাড়াও তিস্তা ও যমুনা নদীর অববাহিকায় স্বাভাবিকের চেয়ে বড় বন্যার শঙ্কা আছে।
সমকাল: এবারের বন্যা কি হঠাৎ এসেছে?
মোস্তফা কামাল: সিলেটে এ বছর যে বন্যা হয়েছে এবং হচ্ছে তার কোনোটিই হঠাৎ হয়নি। আমেরিকার আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আবহাওয়া পূর্বাভাসে আগেই বিষয়টি এসেছে। বড় বন্যার শঙ্কার কথা গত ৪ জুন সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসেছে। এ ছাড়া বেশকিছু টেলিভিশনে ৫ ও ১২ জুন আমি স্পষ্ট উল্লেখ করেছি, জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিলেট বিভাগে খুবই ভারি বৃষ্টিপাত হবে। ৬০০ থেকে এক হাজার মিলিমিটার বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম। ফলে এ কথা বলার সুযোগ নেই, এবারে বন্যা হঠাৎ এসেছে। একইভাবে এ কথা বলা পুরোটাই অন্যায় হবে যে, আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ ছিল না। আগে থেকে প্রচার করলে ক্ষতি কমিয়ে আনা যেত। সরকারি দপ্তরগুলো এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
সমকাল: আমাদের বন্যা প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত?
মোস্তফা কামাল: যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। কিন্তু ১০ থেকে ১৫ দিন আগে পূর্বাভাস মানুষের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করা গেলে জান-মালের ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র সময়মতো পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত জনপদের অনেক মানুষ প্রাণ বাঁচাতে পারলেও তদের ঘরবাড়ি কিংবা গবাদি পশু নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ক্ষয়-ক্ষতি এড়াতে আগে থেকেই নির্ভুল আবহাওয়ার পূর্বাভাস পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে।
সমকাল: আবহাওয়া অধিদপ্তরের সীমাবদ্ধতা কোথায়?
মোস্তফা কামাল: আবহাওয়া অধিদপ্তর আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মডেলের দৈনন্দিন আবহাওয়া পূর্বাভাসের তথ্য অনুসরণ ও বিশ্নেষণ করে কিনা আমি জানি না। পুরো বিশ্বে মাত্র ১৫ থেকে ২০টি দেশ নিজেরা আবহাওয়া পূর্বাভাসের বিশ্বব্যাপী (গ্লোবাল) মডেল তৈরি করেছে। অন্য দেশগুলো নিজেদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য অনুসারে সেসব মডেল ব্যবহার করে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর আবহাওয়া পূর্বাভাসের জন্য নিজেরা যে গাণিতিক আবহাওয়া মডেল ব্যবহার করে, সেটিও আমেরিকার তৈরি। তবে মডেলটি হলো আঞ্চলিক মডেল। আবহাওয়া পূর্বাভাসের গাণিতিক মডেলগুলো চালাতে খুবই উচ্চশক্তির কম্পিউটার দরকার। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, বর্তমানে ডব্লিউআরএফ নামক গাণিতিক আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলটি ব্যবহার করে। এ মডেল থেকে ৭ থেকে ১০ দিনের আবহাওয়া পূর্বাভাস অনেক নির্ভুলভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু সেটি তারা মানুষের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। এ জন্য সব ধরনের গণমাধ্যমের সাহায্য নেওয়া উচিত বলে মনে করি।
সমকাল: সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বন্যার বিপদ বেড়ে গেছে। এবারের বন্যা তো ভয়াবহ…।
মোস্তফা কামাল: বাংলাদেশের উজানের দেশগুলোতে ভূমিক্ষয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। উজানে ভূমিক্ষয়ের কারণে সৃষ্ট বালু ও পলিমাটি পড়ে বাংলাদেশের নদনদী নাব্য হারাচ্ছে। যে কারণে বর্ষার পানি কিংবা অতিবৃষ্টির ফলে সৃষ্ট পলিমাটি জমে নদীগুলোর নাব্য কমে নদীর উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশের নদীর প্রায় সবই ভারত, নেপাল ও ভুটানে উৎপন্ন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত সরকার এই নদীগুলোতে ব্যাপক সংখ্যক বাঁধ নির্মাণ করে পানির স্বাভাবিক চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। যেহেতু এই বাঁধগুলোর বেশিভাগই জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরি করা হয়েছে, তাই এসব বাঁধে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সব সময় পানি ধরে রাখতে হয়। বর্ষাকালে যখন কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিপাত হয় তখন বাংলাদেশের উজানে অবস্থিত সেই বাঁধগুলোর দরজা হঠাৎ খুলে দিতে বাধ্য হয়। যে কারণে ভাটির দেশ বাংলাদেশে হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ বছর সিলেট বিভাগে বন্যার ভয়াবহতা বেড়েছে। একই সঙ্গে মানবসৃষ্ট কারণ যেমন মেঘালয়ের পাহাড়ের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করার কারণে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট পলিমাটি পড়ে সিলেটে বিভাগের নদনদীর নাব্য কমে গেছে। আবহাওয়া সংক্রান্ত কয়েক দিন প্রক্রিয়া একই সময়ে ঘটা যেমন জেট স্ট্রিমের চলার পথ বেশি আঁকাবাঁকা হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের ওপর দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করে। দৈবক্রমে এ বছরে খুবই ধীর গতিতে ভারতীয় উপমহাদেশের স্থলভাগে প্রবেশ করতে থাকা মৌসুমি বায়ুর সঙ্গে মিথস্ট্ক্রিয়ার মাধ্যমে অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেও অল্প সময়ে বেশি পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে। এসব কারণ একই সঙ্গে ঘটায় এ বছর বন্যার ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সমকাল: শুধু কি প্রাকৃতিক কারণে বন্যা বাড়ছে, নাকি আমাদের কোনো সরাসরি ভূমিকা আছে?
মোস্তফা কামাল: সাম্প্রতিককালের বন্যাগুলোর ভয়াবহতা বৃদ্ধির বেশ কিছু মানবসৃষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। যার মধ্যে অন্যতম হলো পাহাড়ের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করায় ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করা এবং অতিবৃষ্টির সময় হঠাৎ বাঁধের সব পানি ছেড়ে দিয়ে বাঁধের ভাটির জনপদে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করা হচ্ছে। যেমন পদ্মা নদীর উজানে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ ও তিস্তা নদীর উজানে ভারতের গজলডোবা বাঁধ থেকে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ বাঁধের সব দরজা খুলে দিয়ে পদ্মা ও তিস্তা নদীর উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে।
সমকাল: সামনে বন্যার প্রস্তুতি কেমন হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মোস্তফা কামাল: আবহাওয়া সম্পর্কিত প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো যেমন অতিবৃষ্টি, শক্তিশালী কালবৈশাখী থেকে সৃষ্ট উচ্চ গতির বাতাস, তীব্র বজ্রপাত ইত্যাদি মানুষের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সঠিক ও সময়োচিত প্রয়োগের মাধ্যমে (যেমন আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেলের যথাযোগ্য ব্যবহার, বন্যা পূর্বাভাসের ব্যাপক প্রচার) প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি থেকে জান-মাল রক্ষা করা সম্ভব। আগে থেকে অতিবৃষ্টির আশঙ্কার কথা দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিয়ে মানুষকে সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত করে রাখতে হবে। অতিবৃষ্টি শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকে বাঁধে জমে থাকা পানি ছেড়ে দিয়ে সম্ভাব্য অতিবৃষ্টির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে অবস্থিত নদীগুলোর পানিপ্রবাহের সঠিক তথ্যের বাধাহীন প্রবাহ নিশ্চিত করে ভাটির দেশগুলো যথেষ্ট আগে সম্ভাব্য বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে পারে।