- সৌতিক বিশ্বাস
- Role,বিবিসি নিউজ, ভারত
-
৭ ঘন্টা আগে
ছয় বছর আগে, উত্তর ভারতের আগ্রা শহরের একটি সুপরিচিত স্কুল থেকে একটি মুসলমান বালক অপমান ও ক্ষোভে রক্তবর্ণ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল।
“আমার সহপাঠরা আমাকে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী বলে ডাকে,” নয় বছর বয়সী ছেলেটি তার মাকে জানায়।
রীমা আহমেদ, একজন লেখক এবং কাউন্সিলর, দিনটির কথা তার এখনও তার স্পষ্ট মনে আছে।
” ক্রদ্ধ ছোট ছেলেটি তার হাতের মুঠি এতটাই শক্ত করে চেপে ধরেছিল যে তার তালুতে নখের দাগ বসে যায়। সে খুব রেগে গিয়েছিল।
তার ছেলে স্কুলের ওই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিল, যখন শিক্ষক ক্লাস থেকে চলে যান, তখন তার সহপাঠীরা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে শুরু করে।
“সেই সময় একদল ছেলে তার দিকে ইশারা করে বলে, ‘ও একটা পাকিস্তানি সন্ত্রাসী। ওকে মেরে ফেল!”
ছেলেটি জানায় যে তার কিছু সহপাঠী তাকে নর্দমার কীট বলেও কটাক্ষ করতো। মিসেস আহমেদ যখন এ নিয়ে অভিযোগ করেন, তখন তাকে বলা হয়েছিল যে তারা “মনগড়া কথা বলছেন… এমন কিছুই ঘটেনি”।
মিসেস আহমেদ তার ছেলেকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনেন। ১৬ বছর বয়সী ছেলেটি বাড়িতে এখন বসে পড়াশোনা করছে।
“আমি আমার ছেলের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা টের পেয়েছি, যে অনুভূতি আমার বেড়ে ওঠায় কখনও পেয়েছি বলে মনে করতে পারি না,” তিনি বলেন।
“হয়তো শ্রেণি সুবিধা আমাদের সবসময় মুসলিম ভাবার থেকে রক্ষা করেছিল৷ এখন মনে হচ্ছে শ্রেণি এবং সুবিধার কারণে আপনি আরও স্পষ্ট লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছে
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে, ভারতের ২০ কোটি মুসলমানদের জীবনযাপন অশান্ত হয়ে পড়েছে।
সন্দেহভাজন গরু ব্যবসায়ীদের গণধোলাই দিয়ে মেরেছে কিছু উগ্র হিন্দু গোষ্ঠী এবং মুসলমান মালিকানাধীন ছোট ব্যবসাকে লক্ষ্যবস্তু করেছে তারা।
মসজিদের বিরুদ্ধে পিটিশন ফাইল করা হয়েছে। মুসলিম নারীদের অনলাইন “নিলাম” করা নিয়ে ইন্টারনেটে ট্রল করা হয়েছে।
ডানপন্থী গোষ্ঠী এবং মূলধারার কিছু গণমাধ্যম “জিহাদ” – “লাভ জিহাদ” এর অভিযোগ দিয়ে ইসলামোফোবিয়াকে উস্কে দিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, মুসলিম পুরুষদেরকে বিয়ের মাধ্যমে হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরিত করার মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে।
এবং মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বেড়েছে- তার তিন চতুর্থাংশ বিজেপি শাসিত অঞ্চলগুলোতে ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
“ভারতের মুসলমান জনগোষ্ঠী যেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে পড়েছেন, তারা নিজের দেশেই অদৃশ্য সংখ্যালঘু,” এ কথা বলেছেন জিয়া উস সালাম, যিনি ‘বিয়িং মুসলিম ইন হিন্দু ইন্ডিয়া’ বইয়ের লেখক।
কিন্তু বিজেপি এবং মি. মোদি ভারতে সংখ্যালঘুদের সাথে দুর্ব্যবহারের বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
প্রধানমন্ত্রী নিউজউইক ম্যাগাজিনকে বলেছেন, “এগুলি কিছু লোকের বক্রোক্তি যারা তাদের বিভ্রমে বাইরে গিয়ে মানুষের সাথে মেশার প্রয়োজন বোধ করে না। এমনকি ভারতের সংখ্যালঘুদের কাছেও এসব ব্যাখ্যা অচল।”
মিসেস আহমেদের পরিবার কয়েক দশক ধরে আগ্রায় বসবাস করছে। তিনি ওই শহরের অলিগলি এবং জনাকীর্ণ বাড়ির মধ্যে থাকা অনেক হিন্দু বন্ধুদের মধ্যে- পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন।
২০১৯ সালে, মিসেস আহমেদ একটি স্কুল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে বের হয়ে যান, যেখানে মাত্র দুজন মুসলমানদের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ভারত বিমান হামলা শুরু করার পর ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটি ম্যাসেজ পোস্ট করা হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন।
গ্রুপের ওই ম্যাসেজে লেখা ছিল “যদি তারা আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত করে, আমরা তাদের বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে হত্যা করব”।
সন্ত্রাসী ও ভারতের শত্রুদের তাদের বাড়ির ভেতরে হত্যা করার বিষয়ে মি. মোদী যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তার সাথে গ্রুপের ওই বার্তার মিল পাওয়া যায়।
“আমি আর শান্ত থাকতে পারিনি। আমি আমার বন্ধুদের বলেছি তোমাদের সমস্যা কী? তোমরা কি বেসামরিক মানুষ ও শিশুদের হত্যাকে প্রশ্রয় দাও?” মিসেস আহমেদ স্মৃতিচারণ করছিলেন। তিনি শান্তির পক্ষে প্রচারণায় বিশ্বাসী ছিলেন।
প্রতিক্রিয়াও আসে সাথে সাথেই।
“একজন জিজ্ঞেস করে, তুমি কি শুধু মুসলিম বলেই পাকিস্তানপন্থী? তারা আমাকে দেশবিরোধী বলেও অভিযুক্ত করে,” তিনি বলেন।
“অহিংসার পক্ষে কথা বলাকে দেশবিরোধিতা বলে গণ্য করা হয়। আমি তাদের বলেছিলাম দেশকে সমর্থন করার জন্য আমাকে সহিংস হতে হবে না। আমি এই গ্রুপ থেকে বের হয়ে যাচ্ছি।”
পরিবেশে যে বদলে গিয়েছে সেটা অন্যভাবেও অনুভব করতে পেরেছেন মিসেস আহমেদ। দীর্ঘদিন ধরে, তার বিশাল বাড়িটি লিঙ্গ বা ধর্ম নির্বিশেষে তার ছেলের সহপাঠীদের জন্য একটি আড্ডার জায়গা হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু এখন “লাভ জিহাদ” এর উৎপাতে হিন্দু মেয়েদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চলে যেতে বলেন তিনি যেন তারা ছেলের ঘরে বেশি সময় না কাটায়।
“আমি আর আমার বাবা, আমার ছেলেকে বসিয়ে বলেছিলাম যে পরিবেশ ভালো নয়- তোমার বন্ধুত্ব সীমিত করতে হবে, সাবধানে থাকতে থাকবে, বেশি সময় বাইরে থাকা যাবে না। বলা যায় না, বিষয়গুলো যেকোনো সময় ‘লাভ জিহাদে’ পরিণত হতে পারে।”
আগ্রার পঞ্চম প্রজন্মের বাসিন্দা পরিবেশবাদী কর্মী ইরামও স্থানীয় স্কুলে কাজ করার সময় শহরের শিশুদের মধ্যে কথোপকথনে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন।
“আমার সাথে কথা বলবেন না, আমার মা বারণ করেছে,” তিনি এই কথাটি একটি শিশুকে তার একজন মুসলিম সহপাঠীর উদ্দেশে বলতে শুনেছেন।